ঢাকা   শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ৫ আশ্বিন ১৪৩১

ফ্যাসিবাদী নিপীড়নের সমর্থক সাহিত্যিক-সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী-শিল্পীদেরও বিচার হবে

Daily Inqilab ইনকিলাব

২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:১৪ এএম | আপডেট: ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:১৪ এএম

বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন হঠাৎ করেই একটি গণঅভ্যুত্থানকে সম্ভব করেনি। এটি ছিল দীর্ঘদিনের নিপীড়ন-বঞ্চনা ও দু:শাসনের চুড়ান্ত পরিনতি। স্বৈরাচারের সুবিধাভোগী একটি ক্ষুদ্র শ্রেণীকে বাদ দিলে দেশের ১৮ কোটি মানুষ ফ্যাসিবাদী শাসনে বঞ্চনা,নিপীড়ন-নির্যাতনের শিকার হলেও দেশের কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, শিল্পী ও বুদ্ধিজীবীদের একটি বড় অংশের হাত ও মুখ ছিল নিবর্তনমূলক আইনের দ্বারা রুদ্ধ। তারা বেশিরভাগ সময়ে রাজনৈতিক বিষয়ে নীরবতা পালন করলেও আরো একটি শ্রেণী সক্রিয় ছিল, যারা মাফিয়াতান্ত্রিক স্বৈরাচারী রিজিমের তল্পিবাহক ও দালাল হিসেবে ক্ষমতার হালুয়া-রুটির অংশীদার হয়েছিলেন। এমনকি ছাত্র-জনতার আন্দোলন যখন তুঙ্গে, জুলাই মাসের মাঝমাঝি সময় থেকে রাজপথে প্রতিদিনই পুলিশের গুলিতে নিরস্ত্র ছাত্র-জনতা হতাহত হচ্ছিল, তখনো স্বৈরাচারের এসব দোসর পুলিশি নিষ্ঠুরতা-নির্মমতার বিরুদ্ধে কোনো প্রতিবাদ না করে আন্দোলন দমনে সরকারের পোড়ামাটি নীতিকেই সমর্থন করেছিলেন। হাজারো শহীদের রক্ত ও আত্মদানের মধ্য দিয়ে স্বৈরাচারি হাসিনার পতনের পর পতিত সরকারের দলদাস পুলিশ, এমপি-মন্ত্রী, রাজনৈতিক সহযোগী, দলদাস বিচারক, আমলা ও লুটেরা ব্যবসায়ীরা আত্মগোপনে চলে গেছে। এদের অনেকেই এখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়ছে এবং খুনি স্বৈরাচারের সহযোগী হিসেবে বিভিন্ন মামলায় গ্রেফতার হয়ে বিচারের আওতায় আসছে। অল্প কয়েকজন চিহ্নিত সাংবাদিক ও সাংস্কৃতিক কর্মীও ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সময় ধরা পড়েছেন। তবে ১৬ বছর ধরে অগণতান্ত্রিক পন্থায় স্বৈরশাসন টিকিয়ে রাখতে যে সব গণমাধ্যম, সাংবাদিক-কলামিস্ট, বুদ্ধিজীবী , শিল্পী ও সাংস্কৃতিক কর্মী ফ্যাসিবাদী বয়ান সৃষ্টি করেছেন, তাদের অপরাধ অকিঞ্চিৎকর নয়। অপরাধী পুলিশ, দুর্নীতিবাজ নেতা-আমলার পাশাপাশি ফ্যাসিবাদের বয়ান সৃষ্টিকারী সাহিত্যিক-সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবীদেরও বিচারের আওতায় আনার ঘোষণা দিয়েছেন তথ্য ও সম্প্রচার বিষয়ক উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম। তাঁর এই সাহসী ঘোষণায় ছাত্র-জনতার দাবির প্রতিফলন ঘটেছে।

পতিত স্বৈরাচার দেশকে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিকভাবে অন্ত:সার শুন্য করেছে। রাষ্ট্রের প্রতিটা প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করে একটি বিচারহীনতার সংস্কৃতি চালু করেছিল। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বহুদলীয় রাজনীতির স্পেস সংকীর্ণ হয়ে পড়লে গণমাধ্যম রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে দেশ ও জনগণের পক্ষে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে থাকে। দলনিরপেক্ষ অবস্থানের মধ্য দিয়ে সাংবাদিক ও শিল্পী-সাহিত্যিকরা জাতির বিবেকের ভূমিকা পালন করে থাকেন। কিছু বিচ্ছিন্ন ব্যতিক্রম বাদ দিলে আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্র গত ১৬ বছর ধরে গণমাধ্যমে মূলত স্বৈরাচারের পুতুল নাচ প্রদর্শন করা হয়েছে। স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে আন্দোলন-সংগ্রাম করতে গিয়ে হাজার হাজার রাজনৈতিক নেতা-কর্মী গ্রেফতার, গুম-খুন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। সেই সাথে কিছু সংখ্যক গণমাধ্যম ও সংবাদকর্মীও নিবর্তনমূলক আইনে আটক ও নির্যাতনের সম্মুখীন হলেও স্বৈরাচারের সুবিধাভোগী গণমাধ্যম, সংবাদকর্মী ও শিল্পী-সাহিত্যিকরা মহানন্দে দিন কাটিয়েছে। নিবর্তনমূলক আইনের দ্বারা ন্যায়পক্ষের সাংবাদিক-কলামিস্টরা যখন অনেকটাই শৃঙ্খলিত, তখন মাফিয়াতন্ত্রের সমর্থক-সুবিধাভোগীরা ফ্যাসিবাদী বয়ান সৃষ্টি করে সরকারের মন্ত্রী-এমপি, পুলিশ-আমলাদের লুটপাট, দখলবাজি, অর্থপাচার ও বিচারহীনতার সংস্কৃতিকেই মদত দিয়েছেন। এমনকি বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের সময়ও এই শ্রেণীর গণমাধ্যম, সাংবাদিক ও সংস্কৃতিকর্মীরা স্বৈরাচারের বশংবদের ভূমিকা পালন করেছে। গুম-খুন- আয়নাঘর, দুর্নীতি-লুন্ঠনের সহযোগী হিসেবে এসব সাংবাদিক-কলামিস্ট, শিল্পীদের বিচারের সম্মুখীন করা এখন সময়ের দাবি। চলচ্চিত্র নির্মাতা মোস্তফা সারওয়ার ফারুকি প্রশ্ন রেখেছেন, হাসিনাকে মনস্টার বানিয়েছিল কারা? ফ্যাসিবাদের তল্পিবাহক শিল্পী, সাহিত্যিক-সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবীরাই হাসিনাকে দৈত্যে পরিনত করেছিল।

বিরতিহীন গুম-খুন, ক্রসফায়ার, হাজার হাজার মিথ্যা মামলায় বিরোধীদলের লাখ লাখ নেতাকর্মীর জীবন বিপন্ন করার পাশাপাশি বিগত ১৬ বছরে দেশে বেশ কয়েকটি গণহত্যা অথবা ম্যাসাকার ঘটেছে। এসব পৈশাচিক অপকর্মের মূল লক্ষ্য ছিল ভারতীয় বশংবদ ফ্যাসিবাদী শাসন ক্ষমতাকে নিরঙ্কুশ ও চিরস্থায়ী করা। দেশে ব্যাঙের ছাতার মত গজিয়ে ওঠা কর্পোরেট মিডিয়া হাউজগুলো স্বৈরাচারের ফ্যাসিবাদী বয়ান মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়ে মানুষকে একটি দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ করতে চেয়েছে। পিলখানায় জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের হত্যা করার সময় একটি টিভি চ্যানেলে তথাকথিত বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনাকে লাইভ টেলিকাস্ট করে বিদ্রোহ ছড়িয়ে দিতে সাহায্য করেছিলেন বলে তৎকালীন এক সেনাপ্রধান অভিযোগ করেছেন। টকশোতে বসে অনেকেই জাতিকে বিভক্তির রূপরেখা জাহির করলেও সরকারের যথেচ্ছ মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে তাদের নিরবতা কিংবা নিরব সমর্থন দেশের মানুষের দৃষ্টি এড়ায়নি। তারা এখন সাধারণ মানুষের কাছে ঘৃণা-অপমানের পাত্র। এমন একটা মাইন্ডসেট তারা তৈরী করতে সচেষ্ট ছিলেন, যা স্বৈরাচারের মাইন্ডসেটের সাথে অভিন্ন। দেশ ও জনগণের স্বার্থকে বিসর্জন দিয়ে শুধুমাত্র অর্থনৈতিক সুবিধা হাসিলে মশগুল ছিলেন। এদের অনেকের সাথে ভারতীয় কিছু প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার নিবিড় যোগসুত্র খুঁজে পাওয়া যায়। এরা কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, শিল্পী ও গবেষকের লেবাস ধারণ করলেও আসরে তারা দেশ ও জাতি বিরোধী, স্বৈরাচারের পদলেহী ও দুর্বৃত্ত। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের রক্তাক্ত দিনগুলোতে সরকারের লেসপেন্সার আরাফাত-পলকদের সাথে হাত মিলিয়ে দেশের বেশকিছু শিল্লী ও সংস্কৃতি কর্মীকেও ‘আলো আসবেই’ শিরোনামের সোশ্যাল মিডিয়া প্লাটফর্মে ন্যক্কারজনক ভূমিকায় দেখা গেছে। কয়েকটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় ও বেসরকারি থিঙ্কট্যাঙ্কও স্বৈরাচারের সহায়ক বয়ান ও ভূয়া পরিসংখ্যানের জন্ম দিয়ে জাতিকে বিভ্রান্ত করেছে। ভবিষ্যতে এ ধরণের বিভ্রান্তি ও প্রতারণা থেকে জাতিকে রক্ষা করতে হলে এদেরকেও বিচারের আওতায় আনতে হবে। উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম এসব বিষয়ে খোলামেলা মত ও মন্তব্য করে ফ্যাসিবাদের বয়ান সৃষ্টিকারীদের বিচারের আওতায় আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তবে এ ক্ষেত্রে কেউ যেন ভুল বিচারের সম্মুখীন না হন সেদিকে বিশেষ সতর্ক থাকতে হবে। গণতন্ত্র, মানবাধিকার এবং বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের বিপক্ষে ভূমিকা পালনকারী সাংবাদিক, গণমাধ্যমকর্মী, সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাক্টিভিস্ট, কন্টেন্ট ক্রিয়েটর এবং শিল্পী-সাহিত্যিকদের আমলনামা তদন্তের আওতায় এনে প্রকৃত অপরাধীদের বিচার নিশ্চিত করতে হবে। একইভাবে যে সব গণমাধ্যম এবং সাংবাদিক ও শিল্পী-সাহিত্যিক বিগত সরকারের সময় বৈষম্যের শিকার হয়েছে, বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ প্রকাশ করতে গিয়ে হামলা-মামলার শিকার হয়েছেন, তাদের যথাযথ মূল্যায়ন করতে হবে।


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

এবার রাবির শেরে-বাংলা হল থেকে লাঠিসোঁটা-হকিস্টিক উদ্ধার

এবার রাবির শেরে-বাংলা হল থেকে লাঠিসোঁটা-হকিস্টিক উদ্ধার

পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে বসবেন ড. ইউনূস

পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে বসবেন ড. ইউনূস

লেবাননে এক বছরের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ বিমান হামলা ইসরায়েলের

লেবাননে এক বছরের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ বিমান হামলা ইসরায়েলের

সাংবাদিকদের কাছে সহযোগিতা চাইলেন পঞ্চগড়ের নতুন জেলা প্রশাসক

সাংবাদিকদের কাছে সহযোগিতা চাইলেন পঞ্চগড়ের নতুন জেলা প্রশাসক

ইনস্টাগ্রামের মতো ফিচার এবার আসছে হোয়াটসঅ্যাপেও!

ইনস্টাগ্রামের মতো ফিচার এবার আসছে হোয়াটসঅ্যাপেও!

যুক্তরাষ্ট্রে কোর্টহাউসে বিচারককে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা

যুক্তরাষ্ট্রে কোর্টহাউসে বিচারককে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা

তাপপ্রবাহ নিয়ে যা জানা গেল

তাপপ্রবাহ নিয়ে যা জানা গেল

৫০০ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ চেয়ে ইন্ডিপেন্ডেন্ট টিভির বিরুদ্ধে মানহানির মামলা

৫০০ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ চেয়ে ইন্ডিপেন্ডেন্ট টিভির বিরুদ্ধে মানহানির মামলা

‘ভারতীয় খাবার জঘন্য’, অস্ট্রেলিয়ান ইউটিউবারের পোস্ট ঘিরে বিতর্ক তুঙ্গে

‘ভারতীয় খাবার জঘন্য’, অস্ট্রেলিয়ান ইউটিউবারের পোস্ট ঘিরে বিতর্ক তুঙ্গে

ট্রাম্পের তথ্য চুরি করে বাইডেন শিবিরে পাঠিয়েছিল ইরান! দাবি গোয়েন্দা সংস্থার

ট্রাম্পের তথ্য চুরি করে বাইডেন শিবিরে পাঠিয়েছিল ইরান! দাবি গোয়েন্দা সংস্থার

সুনামগঞ্জে সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী এম.এ মান্নান গ্রেফতার

সুনামগঞ্জে সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী এম.এ মান্নান গ্রেফতার

ইয়ামালের মাইলফলকের রাতে হারের তেতো স্বাদ বার্সার

ইয়ামালের মাইলফলকের রাতে হারের তেতো স্বাদ বার্সার

আর্সেনালের স্বস্তির ড্র,অ্যাটলেটিকোর দারুণ জয়

আর্সেনালের স্বস্তির ড্র,অ্যাটলেটিকোর দারুণ জয়

হেডের বিধংসী শতকে লন্ডভন্ড  ইংল্যান্ড

হেডের বিধংসী শতকে লন্ডভন্ড  ইংল্যান্ড

পয়েন্ট হারিয়েও শীর্ষে আর্জেন্টিনা,অবনতি বাংলাদেশের

পয়েন্ট হারিয়েও শীর্ষে আর্জেন্টিনা,অবনতি বাংলাদেশের

বিদেশে সাবেক ভুমিমন্ত্রীর আট হাজার কোটি টাকার সম্পত্তি

বিদেশে সাবেক ভুমিমন্ত্রীর আট হাজার কোটি টাকার সম্পত্তি

ইউনূস গুড উইলের প্রতিফলন দেখতে চায় জনগণ: রিজভী

ইউনূস গুড উইলের প্রতিফলন দেখতে চায় জনগণ: রিজভী

সময় থাকতে হাসিনাকে ফেরত পাঠান : ভারতকে দুদু

সময় থাকতে হাসিনাকে ফেরত পাঠান : ভারতকে দুদু

রুশ সেনা কুরস্কের দুটি শহরের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে

রুশ সেনা কুরস্কের দুটি শহরের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে

বিমানবন্দর এলাকা হবে শব্দদূষণ মুক্ত

বিমানবন্দর এলাকা হবে শব্দদূষণ মুক্ত